ডেস্ক নিউজ : দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয় জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ২০২৪ সালে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ভারতে পালিয়ে যায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জুলাই আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্মুখসারিতে দেখা না গেলেও পরবর্তী সময়ে এর কৃতিত্বের দাবি করতে দেখা গেছে। তাদের ভূমিকা কতটা ছিল সেটা নিয়ে বিশ্লেষকসহ অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন রয়েছে।
জুলাই আন্দোলনে অংশ নেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান টুম্পা। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এ শিক্ষার্থী ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই নিজ প্রতিষ্ঠানের একজনকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ভাইরাল হয়েছিলেন। টুম্পা বলেন, ‘ওই সময় পাশে কোনো দল বা সংগঠন দেখেনি। আশেপাশে সবাইকে সাধারণ শিক্ষার্থী, জনগণ ও সহযোদ্ধা হিসেবেই দেখেছি, যাদের কোনো দলীয় ট্যাগ ছিল না। এখন যদি কোনো দল এসে একপাক্ষিকভাবে বলে যে এর মাস্টারমাইন্ড আমরা ছিলাম, আমাদের এ ক্রেডিট ছিল, এটা সম্পূর্ণ আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। কারণ সেসময় আমার যে সহযোদ্ধা ছিল, আমি দেখিনি তাকে বলতে যে আমি এ দলের বা ওই সংগঠনের, আমি এই লিড দিচ্ছি। তখন সবাই লিড দিচ্ছিল।’
টুম্পার ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ঘটনার দিনই শেয়ার করেছিল বিএনপি। নিজেদের ইউটিউবে ভিডিওটি দিয়েছিল তারা। অর্থাৎ, সেসময় দলীয় পরিচয়ে কেউ সামনে না আসলেও মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ছিলেন না সেটাও বলা যায় না। তবে সে আন্দোলনে সম্পৃক্ততা বা নেতৃত্বের দাবির জায়গায় পরিষ্কারভাবে কাউকে একক কৃতিত্ব দেয়ার সুযোগ থাকা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে আন্দোলন দমনে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তখন তাদের তরফ থেকে ক্রমাগত আঙুল তোলা হচ্ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দিকে।
ওই বছরের ১৭ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের ক্যাডার বাহিনী সহিংসতা করে সারাদেশে। বিশেষ করে ঢাকায়, পরিস্থিতি ঘোলাটে করে। তাদের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী সারা বাংলাদেশ থেকে এনে এ শহরে তারা গুপ্তহত্যা করা শুরু করেছে।’একই দিনে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদও বলেছিলেন, ‘তারেক জিয়া বিভিন্নজনকে নির্দেশ দিচ্ছে কোটা আন্দোলনকারীদের ভেতর ঢুকে পড়ার জন্য।’ অবশ্য সেদিন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আন্দোলনে বিএনপির সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিএনপির নৈতিক সমর্থন দেওয়ার কথা বলেন।
জামায়াতে ইসলামীর দিক থেকেও সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয় ১৮ জুলাই। যদিও সমর্থন আর সম্পৃক্ততা প্রকাশ ভিন্ন বিষয়। পরবর্তীতে তারা যেভাবে সম্পৃক্ততার কথা বেশ জোরেশোরে বলেছেন তেমনটা ৫ অগাস্টের আগে দেখা যায়নি।এ নিয়ে বিবিসি থেকে প্রশ্ন করা হলে বিএনপির মহাসচিব অনেকটা বিরক্তিই প্রকাশ করেন। সেসময় প্রকাশ্য সমর্থন দেওয়া হয়নি কেন তেমন প্রশ্ন তোলাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভাজন তৈরির চেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের কালচারে একটা প্রবলেম আছে। ছাত্ররা অনেক সময় ওউন করতে চায় না অন্য দলকে। সমর্থন দিলে এমন একটা কথা বলে দেয় যে তাদের সমর্থন আমাদের দরকার নেই। এসব কারণে যেটাকে বলে সরাসরি সমর্থন দেওয়া… এটা আর মাঠে সমর্থন দেওয়া… আমরা তো মাঠে ছিলামই।’
ছাত্র আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের সঙ্গে বিএনপির এবং তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ বা সংযোগ সবসময় ছিল বলে দাবি করেন তিনি। ওই সময় ঢাকা থেকে বিএনপির সাড়ে তিন হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং সে আন্দোলনকে বিএনপি ওউন করে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। অন্যদিকে, অভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীরও অনেক ক্ষেত্রেই বেশ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘এটার পেছনে যে আমরা ছিলাম এটা গোয়েন্দারা জানতো, সরকার জানতো। এজন্যই তো আমাদেরকে ব্যান করে দিয়েছে, শিবিরকে ব্যান করেছে। আর কোনো দলকে তো করে নাই। এটা যে জামায়াত-শিবিরের একটা আন্দোলন এটা যেন প্রকাশিত না হয়, আমরা চেয়েছি এটা একটা সর্বজনীন রূপ দেওয়ার জন্য।’
তার মতে, যদি এটা প্রকাশিত হতো যে ছাত্রশিবিরের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী এর পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে তাহলে দলটিকে যারা খুব একটা পছন্দ করেন না তাদের হয়তো একটা রিজারভেশন তৈরি হতো। তিনি বলেন, ‘এমনটা হলে সফলতার প্রশ্নটা আরও ডিফিকাল্ট হতে পারতো। সেজন্য আমরা এ কৌশলটা নিয়েছিলাম যেন সকল শ্রেণির মানুষের পার্টিসিপেশন নিশ্চিত হয়।জুলাই আন্দোলনের সময় বিএনপি, জামায়াত ছাড়াও বামপন্থি ও ইসলামপন্থি দলগুলোকেও বেশ সক্রিয় দেখা গেছে। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির যা বলেছেন সেটা থেকেও বোঝা যায়, জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে কাউকে সম্মুখ সারিতে দেখা গেলে তাতে জনগণের সম্পৃক্ততা সেভাবে নিশ্চিত করা যেত না।
অনেকটা একই কথা বলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও। জুলাই আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার প্রশ্নে তিনি নেতৃত্ব ও তৃণমূল পর্যায়ের বিষয়ে আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের সরাসরি কোনো সম্পর্ক ছিল না। আন্দোলনের আসলে কোনো পর্যায়েই ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক দলের যারা তৃণমূলের নেতাকর্মী রয়েছে তারা এ আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ নিয়েছে।
রাজনৈতিক দলের লোকের অংশগ্রহণ থাকলেও তারা তাদের দলীয় পরিচয়ে আসেনি, কারণ দল হিসেবে সামনে আসলে তারা সেভাবে জনসমর্থন পেতেন না বলেও জানান এনসিপির আহ্বায়ক। এর পেছনে অবশ্য এক ধরনের প্রেক্ষাপটও রয়েছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বিভিন্ন সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন করলেও সেভাবে সফল হয়নি। বরং হামলা-মামলা অনেক কিছু মিলে অনেকটা পর্যুদস্ত হয়ে গেছেন। অনেক ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের আটক হতে বা পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে।
৫ অগাস্টের আগে যেভাবে আন্দোলনে বহু পক্ষ এক হয়েছিল, এক বছর পর এসে একই সময়ের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার বয়ান তৈরি হয়েছে। এসব বয়ানে জুলাই আন্দোলনে কৃতিত্বের দাবি থাকলেও বিশ্লেষকেরা সেসব দাবির উদ্দেশ্য বা কারণ ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছেন। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের মতে, আন্দোলন সফল হলে তখন সবাই এর কৃতিত্ব নিতে চায়। তিনি বলেন, ‘আন্দোলন চলার সময় তারা এ দাবিগুলো করেন নাই। কারণ তারা দ্বিধায় ছিলেন, তাদের মধ্যে সন্দেহ ছিল আন্দোলন সফল হবে কি না।’
বিরোধী কোনো দলের আন্দোলন না বরং আওয়ামী লীগ যেমন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল সেটাই সবচেয়ে বড় বিষয় বলে মনে করেন এ গবেষক। পরপর তিনটি নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকার জয়ী হয়। তবে, এসব নির্বাচন নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। এর জেরে জনমনে অসন্তোষ বাড়ে। এমনকি জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর তারা যেভাবে হামলা ও গুলিবর্ষণ চালিয়েছে তাতে অসন্তোষের পরিমাণ আরও বাড়ে। ফলে রাস্তায় নেমে আসে সাধারণ জনগণ। রাজনৈতিক দলের আহ্বানের ক্ষেত্রে সেটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্ভব হতো কি না সেটা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, ‘পাওয়ার পলিটিক্সে যখন ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা থাকে, ক্ষমতার একটা দেনদরবার থাকে সেখানে তাদের এ ক্রেডিটটা সে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আসতে পারে। একদিকে যেমন ক্ষমতার বলয়ে আধিপত্যের প্রসঙ্গ আছে তেমন ভবিষ্যতের রাজনীতিতেও এর উদ্দেশ্যগত ভিন্নতার ব্যাখ্যা রয়েছে।’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এস এম শামীম রেজার মতে, কৃতিত্বের দাবি আসন্ন নির্বাচনের আগে তরুণদেরকে নিজ দলে ভেড়ানোর চেষ্টার অংশ। এমনকি অভ্যুত্থানে সরাসরি যাদের সামনে দেখা গেছে, এনসিপিকেও সেদিক দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করতে হচ্ছে।
এখন আরেকটি প্রশ্নও সামনে আসে যে আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর পেছনে ভূমিকা রাখায় প্রতারণাবোধের জায়গা কাজ করে কি না। রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাসরীন বলেন, এতে আমি প্রতারিত বোধ করি না কারণ আন্দোলনে ন্যায্যতার জায়গা ছিল। সেখানে নিয়ন্ত্রণবাদী রাজনীতি, জনগণকে আমলে না নেওয়া, বিগত নির্বাচনগুলোর অনিয়ম, বিরোধী দলমত দমন, নিপীড়ন, জুলাই আন্দোলনে সহিংসতা এমন অনেক প্রেক্ষাপটেই সরকারবিরোধীতার জায়গা ছিল।
কৃতিত্বের দাবি যে শুধু রাজনৈতিক দলগুলো করেছে তেমন না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ক্ষেত্রেও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এর পরিকল্পনার কৃতিত্ব দিয়েছেন। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন প্রধান উপদেষ্টার সেই বক্তব্যই প্রশ্ন, বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজনের সুযোগ তৈরি করেছে।
কিউটিভি/আয়শা/৩০ জুলাই ২০২৫,/বিকাল ৪:০০