আন্তর্জাতিক ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের প্রধান সাংবিধানিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী এখন কার্যত সামরিক আইনের অধীনে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তি প্রদর্শন করেছে, ওয়াশিংটন ডিসির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, সেখানে পুলিশ পরিস্থিতি সামলাতে অপারগ হয়ে পড়ায় ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে এবং পুলিশ তাদের অধীনস্থ থাকবে। ন্যাশনাল গার্ডের আটশ সদস্য এবং পুলিশের পাঁচশ সদস্য সেখানে টহল দিচ্ছে গত মঙ্গলবার থেকে। বিভিন্ন স্থানে সাঁজোয়া যান অবস্থান নিয়েছে।
ওয়াশিংটন ডিসির স্থানীয় প্রশাসন নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মাথাব্যথার কারণ এ নগরী যে কেবল ডেমোক্রেটিক পার্টি নিয়ন্ত্রিত তা নয়, গত ৫০ বছর ধরে ওয়াশিংটন ডিসিতে যারা মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, তারা সবাই আফ্রিকান-আমেরিকান, অর্থাৎ সোজা কথায় কৃষ্ণাঙ্গ। তাছাড়া এ পাঁচ দশকে কোনো রিপাবলিকান প্রার্থীর পক্ষে রাজধানী শহরের মেয়র নির্বাচিত হওয়া সম্ভব হয়নি, এমনকি কোনো শ্বেতাঙ্গ প্রার্থীর পক্ষেও নয়। কারণ ২০২৪ সালের জুলাই মাসের জনগণনা অনুসারে ৬৮.৩৪ বর্গমাইল আয়তনবিশিষ্ট ওয়াশিংটন ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার ৭০২,২৫০ জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যা ৩৬ শতাংশ। বাকিরা এশিয়ান, হিসপানিক, নেটিভ আমেরিকান ও অন্যান্য। তাছাড়া রাজধানী শহরে প্রতি ১০ জন ভোটারের মধ্যে ৯ জনই ডেমোক্রেট। এসব পরিসংখ্যানের কোনোটিই ট্রাম্পের অনুকূলেও নয়, তার পছন্দেরও নয়।
বর্তমান মেয়র মুরিয়েল বাউসার ৫৩ বছর বয়স্কা কৃষ্ণাঙ্গ নারী, যিনি মেয়র হিসাবে তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২৬ সালের ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় মেয়র নির্বাচনে তিনি চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। মেয়র হিসাবে তিনি প্রথম দায়িত্ব পালন শুরু করেন ২০১৫ সালে। ২০২২ সালে তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৭৫ শতাংশ পেয়ে নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের একটি আইন অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটলে ওয়াশিংটনের স্থানীয় প্রশাসন যদি তা নিয়ন্ত্রণে অসমর্থ হয়, তাহলে ফেডারেল প্রশাসন শহরের পুলিশ বিভাগকে ফেডারেল নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটন ডিসির ক্ষেত্রে আইনটি প্রয়োগ করলেন। রাজধানী নগরী কোনো অঙ্গরাজ্যের অংশ নয়, এটি ইউনিয়ন টেরিটরি হিসাবে ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণেই থাকে। যদিও ওই আইনে ওয়াশিংটনকে স্বায়ত্তশাসন, মেয়র ও কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু স্থানীয় আইন ও বাজেট অনুমোদন করে কংগ্রেস।
সেক্ষেত্রে ট্রাম্পের এ পদক্ষেপকে অস্বাভাবিক বলছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এ আচরণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদের প্রতিফলন, সুবিচার ও নাগরিক অধিকারের চরম অবমাননা এবং অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ রাজধানীতে এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেনি যে, সেসবকে অজুহাত হিসাবে দেখিয়ে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করার প্রয়োজন অনুভূত হতে পারে। তিনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অজুহাত দেখালেও বাস্তব চিত্র হলো, এ বছর ওয়াশিংটনে অপরাধের হার বিগত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিু। তাছাড়া ট্রাম্প এ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময়ের জন্য ফেডারেল নিয়ন্ত্রণে নিতে হলে তা কংগ্রেসকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে হয় এবং সর্বোচ্চ ৩০ দিন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব। ট্রাম্প কতদিন রাজধানীকে তার প্রশাসনের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে রাখবেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই আমেরিকা ক্রমবর্ধমানভাবে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পিচ্ছিল পথে ধাবিত হতে শুরু করেছিল; কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে প্রত্যক্ষ স্বেচ্ছাচারের দিকে রাষ্ট্রের পতন দ্রুততর হয়েছে। জরুরি ক্ষমতার আওতা সম্প্রসারণ করে তিনি অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সামাজিক অসাম্য দূর করার ক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সাধন করতে যাচ্ছেন বলে দাবি করলেও কার্যত সবই তার বাগাড়ম্বর বলে প্রমাণিত হতে বাধ্য। বরং প্রতিটি সমস্যাকে তিনি জটিল সংকটে পরিণত করে চলেছেন। হোয়াইট হাউজে তার গত আট মাসের মধ্যে সর্বশেষ ওয়াশিংটন ডিসিকে নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে ‘জরুরি রাষ্ট্র’ কীভাবে পরিচালিত হয়, তিনি তার প্রকাশ্য প্রদর্শন ঘটালেন। অপরাধ, গৃহহীনতা, অরাজকতার মতো সমস্যাগুলোকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের প্রতি হুমকিতে পরিণত করেছেন।
তিনি জনমনে ভীতির সঞ্চার করার চেষ্টা করেন প্রেসিডেন্ট হিসাবে অধিকতর ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য। সন্ত্রাসের বিস্তারের কথা বলে হোক; নাগরিক জীবনের অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জনস্বাস্থ্য হোক; তার লক্ষ্য অভিন্ন এবং তা হলো, ফেডারেল কর্তৃত্ব সম্প্রসারণ, পুলিশ ব্যবস্থার সামরিকীকরণের যৌক্তিকতা প্রমাণ করা এবং জাতীয় নিরাপত্তার নামে জনগণের অধিকার সংকুচিত করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। এসব ক্ষমতা একবার হাতে পেলে কেউ আর ইচ্ছাকৃতভাবে সেগুলো পরিত্যাগ করে না। অতীতে ট্রাম্প যখনই কোনো সমস্যার সামরিক বিকল্পের ওপর নির্ভর করেছেন, তার অর্থ দাঁড়িয়েছে, তিনি কৃত্রিম উপায়ে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। প্রতিটি পর্যায়ে তিনি কোনো ইস্যুকে সামনে রেখে তার নির্বাহী আদেশ জারি ও জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন, তার অভিযানের আওতা বিস্তৃত হয়েছে।
ট্রাম্পের এসব সিদ্ধান্ত বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। প্রতিবার যেভাবে কোনো না কোনো ইস্যুকে সংকটের রূপ দিয়ে তার এখতিয়ার প্রয়োগ করেছেন, ওয়াশিংটনের স্থানীয় প্রশাসনের আওতাধীন বিষয়কে ফেডারেল নিয়ন্ত্রণে নেওয়া তার প্রশাসনে সমন্বিত প্রচেষ্টার অংশ মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রকে পর্যায়ক্রমে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করার পথে যে বাধাগুলো রয়েছে, ছোট ছোট পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সেগুলো ভেঙে সংবিধান ডিঙানোর সুযোগ সৃষ্টি এবং জনগণের মাঝে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির আগেই সামরিক আইন ঘোষণার সুযোগ নেওয়া। এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা তার পক্ষে আদৌ সম্ভব কিনা, তা চুলচেরা বিশ্লেষণ ও দীর্ঘ আইনি বিতর্কের বিষয় হলেও ট্রাম্পের কথা ও পদক্ষেপে আমেরিকানদের মধ্যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা থেমে নেই।
প্রশাসক হিসাবে ট্রাম্প অত্যন্ত কুশলী। প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি তার পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছিলেন ভয়ংকর অপরাধীদের বিরুদ্ধে, যা দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখা কঠোর পরিশ্রমী অভিবাসীদের বিরুদ্ধে গড়ায়, এরপর তার টার্গেট হয় হোমলেসরা। সময়ের ব্যবধানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী, সাংবাদিক অথবা যারা তার কাঙ্ক্ষিত নন, তারাও যদি তার প্রশাসনের টার্গেটে পরিণত হন, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জারি করা অনেক নির্বাহী আদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই আমেরিকান জনগণের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার শামিল বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। রাজনৈতিক প্রয়োজনে যদি ‘অপরাধী,’ ‘হুমকি,’ এবং ‘বিপদ’কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে পরবর্তী টার্গেট কে বা কারা হতে পারেন, তার নির্দিষ্ট কোনো সীমা বা আওতা থাকে না। ছোট কারণে জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করা শুরু হলে শিগগিরই তা স্বাভাবিক ও স্থায়ী রূপ নিতে পারে। কারণ, আগেও এ ধরনের কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে, যা ক্রমে ব্যাপকভাবে আমেরিকানদের বিপর্যস্ত করেছে।
আগে যা ধীরগতিতে বাস্তবায়িত হয়েছে, প্রাত্যহিক জীবনে প্রভাব পড়তে হয়তো এক বা একাধিক বছর সময় লেগেছে, এখন তা যথাসম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে অনুভূত হবে। প্রতিটি সংকট আমেরিকানদের জন্য একেকটি পরীক্ষা : তারা সামাজিক সমস্যাগুলোর সামরিক সমাধানে পৌঁছতে তাদের অনেকটা অগোচরে সরকারকে সংবিধান এড়িয়ে তার লক্ষ্য হাসিলে কতটা সুযোগ দেবে, জনগণ কোনো সিদ্ধান্ত আপত্তিকর হলেও তা প্রতিরোধ করবে অথবা মেনে নেবে কিনা অথবা যারা কর্তৃত্বের অবস্থানে আছেন, তাদের সীমা অতিক্রম করার সুযোগ দেবে কিনা।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় প্রশাসনে কর্তৃত্বের অধিকারীরা পরিবর্তিত হয়েছেন-বুশ, ওবামা, ট্রাম্প, বাইডেন চলে গেছেন এবং আবারও ট্রাম্প এসেছেন; কিন্তু সবার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি একই রয়ে গেছে। তা হলো, স্থায়ীভাবে সংকট ব্যবস্থাপনার নামে স্থায়ীভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। এর মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক সীমারেখা বিলুপ্ত হয়ে আমেরিকানদের একসময়ের মহান ব্যক্তিস্বাধীনতা দিনে দিনে অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে। তাদের বাধ্য করা হচ্ছে জরুরি অবস্থার নামে স্থায়ী ফেডারেল নিয়ন্ত্রণের মধ্যে বসবাসে অভ্যস্ত হতে। ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক ওয়াশিংটন ডিসিকে প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখন যা ওয়াশিংটনের ক্ষেত্রে ঘটেছে, জাতীয় নিরাপত্তার নামে তা আগামীতে দেশজুড়ে অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রযোজ্য হবে। ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিউইয়র্ককে একইভাবে ফেডারেল কর্তৃত্বে নেওয়ার আভাসও দিয়েছেন।
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক
আয়শা/১৬ আগস্ট ২০২৫/রাত ১১:১২