ডেস্ক নিউজ : আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের এই দিন ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে নিজ বাড়িতে বাংলাদেশের স্থপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ভোর ৪টা ১৭ মিনিট থেকে ভোর ৫টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত ৯৮ মিনিট ধরে এই হত্যাকাণ্ড চলে। বেলজিয়ামে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। সেই ভোরেই মিন্টো রোডে ১৩ জন সদস্যসহ বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি মন্ত্রী সেরনিয়াবাতকে হত্যা করা হয়। ধানমন্ডির আরেকটি বাড়িতে শেখ মনির সঙ্গে হত্যা করা হয় তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে।
বঙ্গবন্ধুর বাসার কর্মী আবদুর রহমান রমা পরে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষী দিতে গিয়ে বলেছেন, লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামতে থাকেন। দোতলায় বেগম মুজিব আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটোছুটি করছেন। তিন তলায় উঠে রমা ডেকে তোলেন শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে। কামাল নিচতলায় নামেন। সুলতানা কামাল চলে যান দোতলায় বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের কক্ষে। শেখ জামাল ও তার স্ত্রীও দ্রুত চলে যান সেই ঘরে।
গোলাগুলির মধ্যেই বঙ্গবন্ধু পাঞ্জাবি পরে নিচের অফিস রুমে আসেন। মহিতুল ইসলামকে নির্দেশ দেন কয়েক জায়গায় ফোন করতে। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই রিসিভার নিয়ে বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।’বঙ্গবন্ধু কথা শেষ করতে না করতেই একঝাঁক গুলি জানালার কাচ ভেঙে অফিসের দেয়ালে লাগে। কিছুক্ষণ পর গুলি থামলে নিচতলায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ?’ এ কথা বলেই তিনি ওপরে চলে যান।
বঙ্গবন্ধু যখন ওপরে উঠছেন, তখনই শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় দাঁড়ান। শেখ কামালের পায়ে গুলি করেন বজলুল হুদা। কামাল বলতে থাকেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে বজলুল হুদা ব্রাশফায়ার করেন। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে করতে একপর্যায়ে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিনকে পেয়ে যান। তাকে তিনি বলেন, ‘জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকেরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’ পরে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে বলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে (শেখ কামাল) বোধহয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’
এরপর ঘাতকরা বাথরুমে আশ্রয় নেওয়া গৃহকর্মী আবদুলকে গুলি করে। বঙ্গবন্ধুর ঘরে তখন তিনিসহ ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। ঘাতকরা ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু ঘরের বাইরে এলে ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে। মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকেন।
বঙ্গবন্ধু তখন ঘাতকদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’ এ সময় সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান নেন বজলুল হুদা ও নূর চৌধুরী। নূর চৌধুরী কিছু একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ান। সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর চৌধুরী তাদের স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করেন। এই হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা পর সেই সময়ের ঢাকা ব্রিগেডের দুজন স্টাফ অফিসারের অন্যতম অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার (বর্তমানে উপদেষ্টা) এম সাখাওয়াত হোসেন স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে সাদা পাঞ্জাবি আর চেক লুঙ্গি পরা বিশালদেহী ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী বঙ্গবন্ধুর মরদেহ। পরিচিত চশমাটি ঠিকরে এক পাশে পড়ে রয়েছে। হাতের পাইপটি আরেক পাশে। সিঁড়িতে চাক চাক রক্ত প্রায় জমাট। পাশে সামান্য জায়গা। সেখানে অনেক বুটের দাগ। এগুলো ঘাতকদের বুটের দাগ।’
বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার পরেই বেডরুমে থাকা বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী ও শেখ কামালের স্ত্রীকে হত্যা করা হয়। হামলাকারীরা নাসের, রাসেল ও গৃহভৃত্য রমাকে নিচতলায় এনে লাইনে দাঁড় করায়। শেখ নাসের নিজের পরিচয় দিলে তাকে বাথরুমে নিয়ে যায়। পরক্ষণেই গুলির শব্দ ও তার আর্তচিৎকার শুনতে পান রমা। আদালতে সাক্ষী রমা জানিয়েছেন, দোতলায় হত্যাযজ্ঞ শেষে শেখ রাসেলকে নিচে নামিয়ে আনলে সে বলে, ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?’ মহিতুল ইসলাম তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘না ভাইয়া তোমাকে মারবে না।’ একবার রাসেল ‘আমি মায়ের কাছে যাব’ বলে কান্নাকাটি করতে থাকে। এরপর তাকে দোতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। শোনা যায় গুলি আর কান্নার শব্দ। এরপর ৩২ নম্বর বাসভবনের সামনে একটি ট্যাংক আসে। ট্যাংক থেকে কয়েকজন আর্মি নেমে ভেতরের আর্মিদের লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করে, ‘ভিতরে কে আছে?’ উত্তরে ভিতরের আর্মিরা বলে, ‘অল আর ফিনিশড্।’
আয়শা/১৫ আগস্ট ২০২৫/বিকাল ৩:৫৫