আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সীমান্তে বছরের পর বছর ধরে চলা উত্তেজনার পর ভারত ও চীন এখন ধীরে ধীরে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। তবে দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস এবং বড় চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে।
সীমান্তে অমীমাংসিত বিরোধই মূল সংকট
ভারত-চীনের উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছে ৩,৪৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ অমীমাংসিত সীমান্ত। পাহাড়, নদী, হিমবাহে ঘেরা এই সীমান্তে প্রায়ই সেনারা মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসেন, যা অনেক সময় সংঘর্ষে রূপ নেয়।
২০২০ সালের জুনে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন ভারতীয় ও ৪ জন চীনা সেনা নিহত হন। এরপর বিভিন্ন স্থানে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে উত্তেজনা চলছেই।
তবে ভৌগলিক বাস্তবতা এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা দুই দেশকে কিছু ক্ষেত্রে সমঝোতার দিকে নিয়ে গেছে। গত বছর লাদাখের প্রধান বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলো নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছায় দিল্লি এবং বেইজিং। চলতি বছরের শুরুতে তারা সরাসরি ফ্লাইট চালু ও ভিসা বিধিনিষেধ শিথিলের সিদ্ধান্ত নেয়। একই সময়ে ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের ছয় বছর পর তিব্বতের কৈলাশ পর্বত দর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়।
অর্থনীতি ও ভূরাজনীতি
চীন ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১২৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ভারতের শিল্প উৎপাদন ও কৃষিক্ষেত্রে চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরতা রয়েছে, বিশেষত দুর্লভ খনিজ পদার্থের ক্ষেত্রে। তাই সীমান্তে শান্তি বজায় রাখা অর্থনৈতিক সম্পর্কের জন্য জরুরি।
চীনও হিমালয় সীমান্তে শান্তি চায়, কারণ তাদের নজর এখন তাইওয়ান এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ইস্যুর দিকে। তবে কৌশলগত দিক থেকে চীন মনে করে, পশ্চিমা দেশগুলো ভারতের মাধ্যমে তাদের প্রভাবকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। তাই সীমান্ত সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি বেইজিং চায় ভারত-চীনের বাণিজ্য ও বিনিয়োগে অগ্রগতি হোক এবং চীনা প্রকৌশলী ও কর্মীদের ভিসা সীমাবদ্ধতা তুলে নেওয়া হোক। (২০২০ সালের সংঘর্ষের পর ভারত অনেক চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ ও বিনিয়োগের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল।)
ট্রাম্পের আমলে আমেরিকার নীতি ও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার শাসনামলে ভারতের দিক থেকে চীনের দিকে হাত বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ভারত ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা শক্ত সমর্থন পাবে, কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে নজর দিচ্ছে দিল্লি।
মে মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনার সময় পাকিস্তান চীনা যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ব্যবহার বাড়ায়। এরপর ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছেন। এতে দিল্লি বিব্রত হয়, কারণ ভারত বলে আসছে কোনো তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়া তারা পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছে। এরপর ট্রাম্প পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে দুপুরের খাবারে আমন্ত্রণ জানান, যা ভারতকে হতাশ করে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, ১ আগস্টের মধ্যে চুক্তি না হলে ভারতের ওপর শুল্ক আরোপ করা হবে। এই পটভূমিতে ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের দিকে এগোচ্ছে।
রাশিয়া ও বৈশ্বিক মঞ্চে চীনের প্রভাব
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মস্কোকে চীনের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। রাশিয়ার এই অবস্থানও চীনের সঙ্গে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য সংঘর্ষে ভারতের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছে।
এদিকে চীন দুর্লভ খনিজ পদার্থ ও সার রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাণিজ্যকে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ভারতের গাড়ি ও কৃষি খাত এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে বিরোধ অটল
চীন সম্প্রতি অরুণাচল প্রদেশকে ‘দক্ষিণ তিব্বত’ হিসেবে দাবি করছে। অন্যদিকে ভারত জানিয়ে দিয়েছে, অরুণাচল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এখানে নিয়মিত নির্বাচন হয়। এই ইস্যুতে কোনো সমঝোতার সুযোগ নেই বলে দিল্লি জানিয়ে দিয়েছে।
সম্পর্ক মেরামত, তবে সীমিত পর্যায়ে
দুই দেশ জানে, সীমান্ত বিরোধ দ্রুত সমাধান সম্ভব নয়। তাই উভয়েই এমন একটি সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে, যা পারস্পরিকভাবে লাভজনক এবং উত্তেজনা এড়িয়ে চলতে সাহায্য করবে, যাতে তারা কোনো বৈশ্বিক শক্তির ওপর নির্ভর না করে নিজেদের অবস্থান রক্ষা করতে পারে।
কিউটিভি/আয়শা//১০ জুলাই ২০২৫,/সন্ধ্যা ৬:০০