আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ডোনাল্ড ট্রাম্প অনুমোদিত তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে মার্কিন হামলার পর ইরান এখন পাল্টা জবাবের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সম্ভাব্য এই প্রতিক্রিয়াগুলোই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ওয়াশিংটনে বলেও জানিয়েছে দ্য টেলিগ্রাফ। প্রভাবশালী এই ব্রিটিশ গণমাধ্যমটি বলছে, ইরানি হামলার আশংকায় মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান ও সৌদি আরবে মোতায়েনকৃত ৪০,০০০ মার্কিন সেনাকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, শনিবার রাতে ৬টি ‘বাংকার বাস্টার’ মিসাইল দিয়ে ইরানের ৩টি পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে।এর কোনো ‘ফলো-আপ’ আক্রমণ আপাতত পরিকল্পনায় নেই। তবে ইরান প্রতিশোধ নিলে জবাব দিতে প্রস্তুত আছে মার্কিন বাহিনী। এ বিষয়ে ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “ইরান যদি অবিলম্বে শান্তি স্থাপন না করে, তাহলে আরও হামলা চালানো হবে।”
এদিকে ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা এক বিবৃতিতে বলেছে, “এই সংস্থা প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। যার মধ্যে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণও রয়েছে। যাতে ভুক্তভোগী ইরানি জাতির অধিকার রক্ষা করা যায়।”
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সম্ভাব্য হুমকিগুলো হলো:
১. ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলা: ইরানের সবচেয়ে প্রচলিত প্রতিক্রিয়া হতে পারে ব্যালিস্টিক মিসাইল ব্যবহার করে হামলা।ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে ইরান।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের দাবি, মার্কিন ঘাঁটিগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান।মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান ও সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্রের ২০টিরও বেশি ঘাঁটি রয়েছে। যার অনেকগুলোই ইরানের সেজিল-২ ক্ষেপণাস্ত্রের ২,০০০ কিমি রেঞ্জের মধ্যে।তবে ইরাক ও সিরিয়ার ঘাঁটিগুলোই প্রথম টার্গেটে হতে পারে।
টেলিগ্রাফের দাবি, ২০২০ সালে সোলাইমানিকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইরান যে ধরনের হামলা চালিয়েছিল, তা প্রাণহানির কারণ না হলেও ১১০ জন মার্কিন সেনা মাথায় আঘাত ও কনকাশনে আক্রান্ত হয়। এবারও তেমন আঘাত হানার চেষ্টা হতে পারে।
তবে ইরানি হামলার জবাব দিতে মার্কিন বাহিনীর এফ-২২, এফ-১৬ ও এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ইতোমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করা হয়েছে।
২. মার্কিন দূতাবাস ও কনস্যুলেটে হামলা
টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাগদাদের মার্কিন দূতাবাসকে প্রধান লক্ষ্য বানাতে পারে ইরান।এই আশংকায় দূতাবাসটি ইতোমধ্যে প্রায় পুরোপুরি খালি করে ফেলা হয়েছে।এছাড়া ইসরাইলের মার্কিন দূতাবাসও খালি করে ফেলা হয়েছে।
৩. তেল ও এলএনজি স্থাপনা
টেলিগ্রাফের ভাষ্য, ইরান যদি মনে করে তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে, তাহলে সৌদি আরব, ইউএইসহ উপসাগরীয় অঞ্চলের জ্বালানি স্থাপনায় হামলা হতে পারে।
২০১৯ সালে আবকাইক ও খুরাইস তেল স্থাপনায় ড্রোন ও মিসাইল হামলা চালানো হয়েছিল—যা তখন সৌদির অর্ধেক উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছিল।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আবকাইক সবচেয়ে সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। এছাড়া ইউএই-তে ফুজাইরাহ উপকূলে তেলবাহী জাহাজেও হামলা হতে পারে।
৪. হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ২০ শতাংশ তেল এই পথ দিয়ে যায়। ইরান সহজেই এই প্রণালীকে মাইন পুঁতে বন্ধ করে দিতে পারে এবং জাহাজ চলাচল স্তব্ধ করতে পারে।
তবে, এটি করলে চীনসহ অন্যান্য বড় ক্রেতা দেশ ক্ষিপ্ত হবে—যা ইরানকে আন্তর্জাতিকভাবে সম্পূর্ণভাবে একঘরে করে ফেলতে পারে।
৫. প্রক্সি গোষ্ঠী ব্যবহার
ইরানের সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হলো প্রক্সি গোষ্ঠী ব্যবহার করে হামলা চালানো—যেমন: হিজবুল্লাহ ও হামাসকে দিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামলা, হুথি নিয়ন্ত্রিত ইয়েমেনি বাহিনীর মাধ্যমে লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা, কাতাইব হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীকে দিয়ে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা ইত্যাদি।
তবে হামাস ও হিজবুল্লাহ’র ওপর ইসরাইল যে বিপর্যয় নামিয়ে এনেছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্বস্তির বিষয় হয়ে এসেছে।
৬. সাইবার হামলা
ইরান ও তার মিত্র গোষ্ঠীগুলো ইসরাইলে বহু সাইবার হামলা চালিয়েছে। যেমন- ডেটা নষ্ট, ফিশিং, অপপ্রচার ইত্যাদি। এজন্য অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র “CyberAv3ngers” নামক একটি দলকে ধরিয়ে দিতে ১ কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমান সংকটে ইরান বড় ধরনের সাইবার হামলা চালাতে পারবে না।
পরিশেষে বলা যায়, মার্কিন হামলার জবাবে ইরান পাল্টা আঘাত হানতে পারে ব্যালিস্টিক মিসাইল, প্রক্সি হামলা, হরমুজ প্রণালী বন্ধ বা তেলের স্থাপনায় আঘাতের মাধ্যমে। তবে প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক ঝুঁকি—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি যুদ্ধ জড়ানোর আশঙ্কা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ মুহূর্তে ইরান সীমিত প্রতিক্রিয়া জানাবে। কারণ পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু করলে তা তেহরানের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।
কিউটিভি/আয়শা/২২ জুন ২০২৫, /বিকাল ৪:৩৪